Tuesday, September 15, 2020

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৭)

 শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৭)

১৯৭২ - ৭৩ সাল সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। রেলপথ, নৌপথ, রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, স্কুল কলেজ ধ্বংস, ভঙ্গুর অবকাঠামো, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থিনীতি। নেই নিজস্ব কোনো বিমান। অচল অকেজো সমুদ্র বন্দর। বন্দরে মুক্তিযোদ্ধাদের ডুবিয়ে দেয়া অসংখ্য জাহাজ ও পুঁতে রাখা মাইন। সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের হাতে ও রাজাকার, আলবদর আলশামস ও পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া অস্রে সয়লাব। চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানি বেড়ে গেছে। পাকিস্তানি দালাল ও কিছু কুচক্রীর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ধান,চাল,গম, পাটের গুদামে আগুন লাগানো ও লবন গম সহ খাদ্যের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া ছিলো প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার !!

হানাদার পাকিস্তানিরা সারেন্ডারের পূর্বে বিভিন্ন জেলায় এমন কি বাংলাদেশ ব্যাংক ( State Bank of East Pakisthan) এর ট্রেজারী তেও নোটের বান্ডিলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

সদ্য স্বাধীন দেশের কারেন্সি বলে কিছু ছিলোনা। কারেন্সি ছাপাতে যে অর্থের প্রয়োজন তাও নেই আমাদের। ভারত শুভেচ্ছা স্বরূপ প্রথমে কিছু টাকা চাপিয়ে দিলো। যা ছিলো অত্যন্ত নিন্মমানের কাগজের। অনেকটা লটারী টিকিটের মত। কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে নকল টাকার ছড়াছড়ি। ফলস্বরূপ মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি! পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত পূর্ব জার্মানি থেকে কারেন্সি ছাপিয়ে এনেছিলেন।

তার উপরে বাড়তি যোগ হয়েছে বিরোধী রাজনীতির নামে নৈরাজ্য খুন অরাজকতা। ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কথা থাকলেও তা ব্যর্থ হলো। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, গণবাহিনী, স্বাধীন পূর্ব বাংলা, শ্রেণী শত্রু খতম, সর্বহারা ইত্যাদি নানান ভাওতাবাজি দেশে আরও জটিল অশান্তি সৃষ্টি করলো !

যা প্রকারান্তরে দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের হাত কে শক্তিশালী করে বঙ্গবন্ধু ও দেশের বিরুদ্ধে ব্যাপক চক্রান্তের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলো।

এমনিতর একটি খারাপ পরিস্থিতি তে বঙ্গবন্ধু মেয়েদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা আপাততঃ স্থগিত ঘোষণা করলেন। আর সেই ঘোষণার বিরুদ্ধে আমরা কজন কিশোরী সার্বিক অবস্থা না বুঝেই প্রতিবাদ করেছি !

কিন্তু কি আশ্চর্য এমনি পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের ও শেখ কামাল ভাইয়ের অনুমতি ও সাহস সহযোগিতা আমরা পেলাম সেই আন্দোলনে! আজকের এই নষ্ট রাজনীতির যুগে আমি ভাবতেও পারিনা সরকারের ছাত্র সংগঠন আন্দোলন করছে সরকারের বিরুদ্ধে !!
খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে !!!
আর সেখানে আড়াল থেকে উৎসাহ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের পুত্র শেখ কামাল !!!

এটাই বোধ করি গণতন্ত্র। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সাংগঠনিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার। যা আজকের বাংলাদেশে কল্পনায় আনতেও ভয় হয়।


পরবর্তী কালে প্রধানমন্ত্রী পুত্রদের দেখেছি বিরোধী দলকে নিস্তব্ধ নিঃশেষ করে দিতে ইতিহাসের লজ্জাজনক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করতে কিংবা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে মাঠে মহড়া দিতে।

যাক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমরা পরের দিন থেকেই নেমে পড়লাম মাঠ গোছাতে। মূলতঃ ডাবলু ভাইকে সাথে নিয়ে আমরা দুজন ( আমি ও পারভীন) বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বিষয়টি ছাত্রীদের বুঝিয়ে তাদের অধিকার আদায়ে আমাদের সাথে সম্পৃক্ত করতে শুরু করলাম।

লালমাটিয়া গার্লস স্কুল, মোহাম্মদপুর গার্লস স্কুল, রায়ের বাজার টালী অফিস গার্লস স্কুল, কলাবাগান লেকসার্কস গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমরা প্রথম ধাপে ঐক্যবদ্ধ করলাম।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা প্রত্যেক স্কুলের তিন- চার জন মেয়েকে নিয়ে একদিন সকাল ৮ টা - সাড়ে ৮ টা নাগাদ গেলাম ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধুর বাসায়। আমরা পৌঁছাতেই গেট খুলে আমাদের ভেতরে নেয়া হলো। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধুর দরজা সকল বাঙালির জন্যই ছিল উম্মুক্ত। বঙ্গবন্ধু মেয়েদের কথা শুনে বেরিয়ে এলেন সামনের বারান্দায়।


সেই মুহূর্তের আবেগ ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত অনুভূতি আজও চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। জীবনে প্রথম এত কাছ থেকে দেখছি জাতির পিতাকে। আমরা টুপ টুপ করে পা ধরে সালাম করলাম সবাই। বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত বুলিয়ে স্বভাব সুলভ ভাবে জিজ্ঞেস করলেন-
" কিরে কি সমস্যা তোদের ?"

চলবে-------

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৮)

 

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৮) https://www.facebook.com/nazma.a.kawsar? 

বঙ্গবন্ধু কে সামনে দেখে আমি বেশ আবেগ আপ্লুত হলাম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতা আমাদের বাংলাদেশের স্থপতির সামনে আমি দাঁড়িয়ে। কিন্তু উনার সাবলীল স্নেহময় কথায় মনে হলো উনি যেন কতো আপন।

যেহেতু মূল নেতৃত্বে ছিলাম লালমাটিয়া গার্লস স্কুল তাই আমরাই কথা বললাম। সংক্ষেপে বিষয়টি বঙ্গবন্ধু কে জানালাম। উনি শিক্ষা মন্ত্রী ইউসুফ আলীর সাথে আলাপ করবেন বললেন।
উনি হানিফ ভাই ও মহিউদ্দিন ভাই কে ডেকে বললেন আমাদের দাবি গুলো লিখে নিতে। সেখানে তোফায়েল ভাই ও ছিলেন তখন।
আমরা আমাদের দাবী গুলো লিখে দিলাম।


প্রথমত: মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে হবে। দ্বিতীয়ত: পাঁচ মাসের বকেয়া বেতন মওকুফ করতে হবে। এছাড়াও গার্লস স্কুলের বিষয়ে আমরা আরো কয়েকটি বাড়তি দাবি দাওয়া লিখে দিয়েছিলাম এতদিন পরে আজ আর সেগুলো মনে নেই। সেদিনের মতো আমরা বিদায় নিলাম।

তার সপ্তাহ খানেক পরে আমরা লালমাটিয়া গার্লস স্কুল, মোহাম্মদপুর গার্লস ও টালী অফিস গার্লস স্কুল এর ছাত্রীরা মিলে সকালে মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়ার কর্মসূচি নিলাম।

জুন মাসের নির্দিষ্ট দিনে আমরা সকালেই গিয়ে স্কুলে ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে দিলাম। হেড মিস্ট্রেস যখন শুনলেন বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাবো শুনে তিনি হতবাক কিং কর্তব্য বিমূঢ় ! উনি কিছু বলার আগেই ছাত্রীরা সব হুড়মুড় করে দৌড় দিলো বাইরে।
কে শুনে কার কথা ছাত্রীরা ততক্ষনে গেটের বাইরে। গেটের দারোয়ান আমাদের পক্ষে 😉 ( আগেই ম্যানেজ)।

 মোহাম্মদপুর স্কুল থেকে আপেল, সাগর ( ফর্সা লুৎফর ভাইয়ের ভাগ্নি) এর নেতৃত্বে মিছিল এলো। তত্ত্বাবধানে পিয়ারু ভাই বাদল ভাই।
টালী অফিস স্কুলের বেশ কজন এলো ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতা জগলু ভাইয়ের নেতৃত্বে। সার্বিক নেতৃত্বে ডাবলু ভাই, সিরাজ ভাই, রিয়াজ ভাই।

সবাই কে একত্র করে আমরা লালমাটিয়া স্কুলের নেতৃত্বে মিছিল নিয়ে গেলাম বঙ্গবন্ধু ভবনে।

৩২ সে ঢুকার মুখেই কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা। উনাকে আমাদের সাথে যেতে অনুরোধ করতেই বললেন: "আব্বার সামনে আমি ভয়ে যাইনা, তোরা যা। সব বলবি ভালো করে।"

কয়েক শত মেয়ে নিয়ে আমরা যখন হাজির হলাম তখন বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন গেটের বাইরে।


প্রথমেই অবাক হয়ে বলে উঠলেন:
" হায় হায় তোরা করছোস কি ! এতো ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে তোরা এতদূর আসছিস ! যদি কেউ হারিয়ে যায় গাড়ির নীচে পড়ে !! "

তৎক্ষনাৎ পুলিশদের ডেকে বললেন মিছিলের সামনে পেছনে ব্যারিকেড দিতে। একটি বাচ্চাও যেনো বাইরে না যায়। আর কাজ শেষে পুলিশ অবশ্যই যেনো তাদের নিজ নিজ স্কুলে পৌঁছে দেয়।

তখন মনে হলো এই জন্যই তিনি জাতির পিতা, মানুষ কে আপন করে ভালোবাসার জন্যই তিনি মহান নেতা। এখন বুঝি আমাদের আসলে ভালো মন্দ বুঝার মতো বয়স ও তখন হয়নি। আর নেতারাও হয়তো উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিলেন এসব সতর্কতা। 

যাক বঙ্গবন্ধু বললেন," আমি তো বলেছি বিষয়টা দেখবো। পাগল..... তোরা আবার কেনো সবাই কে নিয়ে আসলি। "



তার পর তিনি আমাদেরকে কুশলাদি জানতে চাইলেন। বললেন এখন অফিসে যাবো তোদের আর মিছিল নিয়ে আসতে হবেনা। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন আসলেই হবে।

হঠাৎ দেখলাম আমি যখন দীর্ঘদেহী সুদর্শন বঙ্গবন্ধুর সাথে উপর


দিকে তাকিয়ে কথা বলছি, তখন ক্লাস সেভেনের দুষ্ট প্রিসিলা নিচে বসে বঙ্গবন্ধুর পায়জামা ধরে কি যেনো করছে 😊 !!
আমিতো বঙ্গবন্ধু প্রশ্নের উত্তর দিতেই ব্যস্ত।

এসময় বঙ্গবন্ধু বারবার এদিক ওদিক দেখছিলেন। বিষয়টি বেশ পরে বুঝেছিলাম।আর আমাদের ছাত্রলীগের নেতারা কেউ দেয়ালের আড়ালে কেউ গাছের আড়ালে লুকচ্ছিলেন 😊

বঙ্গবন্ধু বিদায় নিয়ে অফিসে চলে গেলেন। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আমাদের (গার্ড অফ অনার 😀) মানে পাহারা দিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিলেন। প্রাথমিক বিজয়ে আমরা মহা আনন্দিত।

চলবে-------- 

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৯)

 

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৯)

স্কুলে ফিরেই প্রিসিলা কে জিজ্ঞেস করলাম তুমি নীচে বসে বঙ্গবন্ধুর পায়জামা ধরে কি করছিলে ?
ওর সাদা মাটা উত্তর আমি বঙ্গবন্ধুর পায়জামা ধরে দেখছিলাম উনি কি আমাদের মতোই কাপড় পরেন নাকি অনেক দামি কিছু। বললাম তো কি দেখলে ?


হতাশ সুরে বললো না আমাদের মতোই পপলিন কাপড়ের পায়জামা। ভেবেছিলাম দামি কিছু হবে হয়তো। ওর উত্তর শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি।

এর সপ্তাহ খানেক পরেই বিভিন্ন দাবীতে সারা দেশ জুড়ে প্রায় দুই মাস শিক্ষক ধর্মঘট শুরু হলো। নিরুপায় হয়ে আমি পারভীন ডাবলু ভাইকে নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে, স্কুলের আসে পাশের লোকজন থেকে জিজ্ঞাসা করে করে জেনে ক্লাস নাইন ও টেনের ছাত্রীদের আমাদের আন্দোলনে শরিক করতে শুরু করলাম। শেখ কামাল ও ছাত্রলীগ সাথে আছে শুনলে ছাত্রী ও অভিবাবকগণ ও রাজি হতেন।

এভাবে আমরা ঢাকার বেশ কিছু গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করেছিলাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আজিমপুর গার্লস হাই স্কুল, ধানমন্ডি গার্লস হাই স্কুল, কামরুন নেসা গার্লস হাই স্কুল, লেক সার্কাস গার্লস হাই স্কুল, উদয়ন হাই স্কুল, সিদ্দেশরী গার্লস হাই স্কুল, টালী অফিস গার্লস হাই স্কুল, মোহাম্মদপুর গার্লস হাই স্কুল ও লালমাটিয়া গার্লস হাই স্কুল।

এক পর্যায়ে এই শিক্ষক ধর্মঘটের মধ্যেই আমরা একদিন বেশ কজন মিলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে তৎকালীন গণভবন বর্তমান সুগন্ধায় গেলাম। কিন্তু ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ডি পি ধর এসেছিলেন বলে সেদিন আর আমাদের ঢুকতে দেয়া হলোনা।

এর দু তিন দিন পরেই আমরা আবার একদিন সকালে গেলাম গণভবন। মজার বিষয় হলো টাকা পয়সা না থাকায় আমাদের যাতায়াতের বিষয়টি বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল 😋। স্কুল ড্রেস পরা ৪-৫ টা মেয়ে হটাৎ যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কারো গাড়ি থামিয়ে বলে আমাদের কি একটু গণভবনে নামিয়ে দেবেন ! অবাক হলেও যে কেউ মনে হয় এখনো এই উপকার টা সানন্দে করবেন। তবে আমাদের সৎ সাহস ছিল বলতেই হয়। ( কিছুটা মাস্তানি অবশ্য ছিল এটাও বলা যায় 😀)।

সুগন্ধার গেট থেকে বলে দিল বঙ্গবন্ধু মিটিং এ বিকেল ছাড়া দেখা হবেনা। আমরাও না ছোড় বান্দা। আমরা সিদ্ধান্ত নিনাম আজ বিকেলে হলেও আমরা দেখা করবোই বঙ্গবন্ধুর সাথে।
আমরা সারাদিন সবাই না খেয়েই বসে রইলাম পাশের রমনা পার্কে। আমি পারভীন, আপেল, সাগর, সুইটি আর মেয়েদের নাম মনে নেই এখন আর। সাথে অবশ্য ছাত্রলীগের ডাবলু ভাই, পিন্টু ভাই, শিরাজ ভাই, রিয়াজ ভাই আরো কয়েকজন ছিলো।

বিকেল ৪ টার দিকে আমরা মেয়েরা গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম। বঙ্গবন্ধু গাড়িতে করে বের হচ্ছিলেন। গেট খুলতেই আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে তিনি নেমে এলেন।
জানতে চাইলেন " কি খবর তোরা কখন এসেছিস "।
সকালে- বলতেই বললেন
"সারাদিন তোরা কোথায় ছিলি "
রমনা পার্কে - বলতেই বললেন "মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে তোরা কিছু খাসনি। চল আমার সাথে। আমি সংসদ অধিবেশনে যাচ্ছিলাম। আয় আমার সাথে।"

বলেই বঙ্গবন্ধু আমাদের নিয়ে আবার সুগন্ধা মানে গণভবনে ঢুকলেন। হাক ডাক শুরু করে দিলেন। "এই এদের আগে কিছু খেতে দে।"

তারপর রুমের ভেতর দাঁড়িয়েই আমাদের সাথে কথা বলতে লাগলেন।
মাথায় হাত রেখে বললেন-
"এই তুই কোন ক্লাসে পড়স ?
আমি টেন বলতেই বললেন- "তো তোর কি। সমস্যা তো অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের।"
ঝটপট জবাব দিলাম- ওরা তো ছোট। আমরা বড়রা না দেখলে ওরা কি পারবে।
গম্ভীর স্বরে বললেন - " হুমম।

আমি তো ইউসুফ আলীকে বলে দিয়েছি।"
আমার জবাব ছিলো- আমরা কাউকে চিনিনা বঙ্গবন্ধু, আমরা আপনাকে চিনি আমরা আপনার কাছেই আসবো। সবাই সমস্বরে বকতে লাগলো কথাগুলো।

এবার বঙ্গবন্ধু একটু বিমোর্ষ চিন্তিত হয়ে জবাব দিলেন- " সবাই বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু করো, বঙ্গবন্ধুর কাছে কি যাদু আছে। দেশে কত সমস্যা। রাতে ঘুমাতে পারিনা চিন্তায়। কিভাবে দেশ


চালাবো"

এমন আরো কিছু কথা যেনো নিজের মনেই বললেন। অনেক পরে বড় হয়ে বঙ্গবন্ধু কে বুঝেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর কষ্টের কথাগুলি অনুধাবন করতে চেষ্টা করি আজও 😥

কঠিন কথাগুলো না বুঝেই বললাম বঙ্গবন্ধু আপনি বলেন তো আইয়ুব খান যদি এটা করতো তবে আপনি তো সবার আগে প্রতিবাদ করতেন।
বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন- "তোদের এই কথাগুলো কে শিখিয়ে দেয় বলতো।"
কেউ শেখায় না আমরা তো আপনার কাছ থেকেই শিখেছি।
হটাৎ বঙ্গবন্ধুর নজর গেলো জানালার বাইরে ছাত্রলীগের নেতাদের দিকে। তিনি হেসে হাতের ইশারায় ডেকে বললেন- "ও নাটের গুরু তা হলে তোমরাই, এবার বুঝলাম। আসো আসো ভেতরে আসো।"
সবাই ভেতরে এলো।

চলবে -----

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ১০)

 শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ১০)


বঙ্গবন্ধু কতো উদার কতো বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন যা হয়তো আমাদের অনেকেরই বোধ বুদ্ধি বিবেচনা ও কল্পনার বাইরে।
বঙ্গবন্ধু কে ধারণ করা তাঁর আদর্শ মহানুভবতা অনুসরণ করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। অসাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তা,স্বরণ শক্তি ও মানবিক গুণাবলীই উনার মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু, সেখান থেকে জাতির পিতা হয়ে উঠার অন্যতম কারণ।

আর তেমনি একজন পিতার গর্বিত সন্তান দৃঢ় চরিত্রের বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল পিতার সিদ্ধান্তের বিপরীতে কথা বলতেও পিছ পা হননি।

আজকের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক এর এই রাজনীতিতে আমরা এমন কয়টি উদাহরণ দেখতে বা দেখতে পারবো জানিনা। খোদ জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের দলের ছাত্র সংগঠনের উনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা দেখেও বুঝেও উদার হাসি দিয়ে তা মেনে নিলেন !! 👌

তেমনি ভাবে কোন প্রধানমন্ত্রী পুত্র সেই আন্দোলন গড়ে তোলার সাহস ও সক্ষমতা দেখতে পারবেন !

তৎকালীন গণভবনে অর্থাৎ সুগন্ধায় বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের নেতাদের দেখেও শুধু হেসে "ওহ তোমরাই নাটের গুরু" কথাটি ছাড়া আর কিছুই বললেন না।

আমাদের নির্দেশ দিলেন -
"তোরা আর কষ্ট করে আসবি না আমার কাছে। তোদের নেতা শেখ শহীদ আছে, তার সাথে যোগাযোগ করে খবর জেনে নিবি।"

তারপর আমাদের খাওয়া দাওয়া শেষে গণভব

নের গাড়ী করে পৌঁছে দেবার নির্দেশ দিয়ে তিনি সংসদের উদ্দেশ্যে বিদায় নিলেন।

বঙ্গবন্ধু জাতীয় পিতা দেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি সংসদে না গিয়ে ওই মুহূর্তে গাড়ি থেকে নেমে আবার আমাদের নিয়ে সুগন্ধায় ঢুকলেন, আমাদের খাবার দেবার নির্দেশ দিলেন, কথা বললেন, আমাদের আশ্বস্ত করলেন তিনি কিছু একটা অবশ্যই করবেন আমাদের যাতে বাড়ি পৌঁছাতে কোন অসুবিধা না হয় সরকারী গাড়িতে পৌঁছে দেবার নির্দেশ দিলেন।


আপনারা যারা পাঠক তারা কিভাবে বিষয়টি দেখছেন ভাবছেন জানিনা। আমি শুধু এটুকু বুঝি, আমি আমরা সৌভাগ্যবান, যাদের জীবনে তাঁকে এমন করে এভাবে দেখার দূর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিলো।

বঙ্গবন্ধুর আকাশ সমান উদারতার, মহত্ত্বের, বিশালত্বের, নেতৃত্বের পরিমাপ করার যোগ্যতা দুঃসাহস কোনটি ই আমার নেই। শুধু বলবো আমরা ঋণী কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে।
ঋণী বাংলাদেশ। 🇧🇩

এর কিছুদিন পরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের সংগঠিত সব স্কুলের হেড মিস্ট্রেস কে তাঁর স্কুলের কারা করা আন্দোলন করছে তাদের দু একজন কে নিয়ে মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠালেন। সবই গেলেও আমরা গেলাম না।
কারণ আমাদের হেড মিস্ট্রেস শ্রদ্ধেয় খাদেষ্টা আপা আমাদের না নিয়ে একাই গেলেন। উনার জবাব ছিল স্কুল বন্ধ তাই কাউকে না সম্ভব হয়নি। ( যদিও আমাদের ঠিকানা উনার জানাই ছিলো)
পক্ষান্তরে অন্য স্কুলের ছাত্রীরা তাদের শিক্ষিকার শেখানো মতে বলে আসলো, আমরা কিছুই জানিনা, সব লালমাটিয়া স্কুলের ছাত্রীরা করেছে !

দিলো আমাদের পুরো আন্দোলনের বারোটা বাজিয়ে!!

শেখ শহীদ ভাই তখন ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসায় ই থাকতেন। আমি পারভীন প্রায়শই সেখানে যেতাম উনাকে ও কামাল ভাই কে বিষয়টি নিয়ে তাগাদা দিতে।

এদিকে ধর্মঘট শেষে স্কুল খুললো। ছাত্রীদের প্রায় ৭ মাসের বেতন বাকি পড়লো। প্রায় কদিন পর পরই নিয়মিত আমার ডাক পড়তে থাকলো হেড মিস্ট্রেস এর রুমে।

প্রশ্ন একটাই আর কতো দিন আমরা বেতন না নিয়ে অপেক্ষা করবো শুধু তোমার কথায় ?
উত্তর ও একটাই - " বঙ্গবন্ধু কথা দিয়েছেন বেতন মাফ করবেন।"
আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু নিরাশ করবেন না। হেড মিস্ট্রেস আপার প্রচ্ছন্ন স্নেহ ছায়া ছিলো বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। একদিন তো অন্য শিক্ষক রা ক্ষেপে গিয়ে বললেন

- এই মেয়েটার কথায় কেন যে আপনি বিশ্বাস করছেন বুঝিনা!
দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর মাস শেষের পথে আমাদের মবের ভেতর ধুক করছে।

অবশেষে এলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই বহুল প্রত্যাশিত নোটিশ। লালমাটিয়া গার্লস হাই স্কুলের ৯ মাসের বেতন মওকুফ করা হলো। খুশিতে বিজয়ে আমরা ছাত্রীরা উচ্ছসিত আত্মহারা। সভায় স্লোগান তুললো :

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা রেখেছেন। দেশের হাজার লক্ষ সমস্যার মাঝে জাতির পিতা ভুলে যাননি এতো ক্ষুদ্র নগণ্য আমাদের। এখানেই বঙ্গবন্ধু অসাধারণ ও অনন্য উচ্চতায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাতির পিতা।
আমরা বিকেলে ছাত্রলীগ অফিসে ছুটলাম।

চলবে---------

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ১১)

 

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ১১)

আমাদের বিজয়ে ছাত্রলীগ অফিসে সবাই আনন্দিত উল্লসিত হলো, মিষ্টি খাওয়া হলো। আমরা আমাদের চার মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য হলাম প্রশংসিত।

"বঙ্গবন্ধু" আমাদের দাবী পূরণ করেছেন এর চাইতে আর বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!

এই ঘটনাটি আমার জীবনের অন্যতম একটি আনন্দের সাফল্যের ও চমৎকার ঐতিহাসিক একটি ঘটনা বলেই আমি মনে করি। যা অনন্য অসাধারণ মধুর স্মৃতিময়।

আজ এতো গুলো বছর পরেও বঙ্গবন্ধুর সেই পিতৃস্নেহের স্নেহ মাখা হাত যেন আমার মাথায় ছুঁয়ে আছে আজও।

আমাদের প্রিয় নেতা কমান্ডার শেখ কামাল ভাইয়ের ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব শেখ শহিদুল ইসলাম ভাই এবং সিটি ছাত্রলীগের সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা না থাকলে আমরা কিছুতেই এই সাফল্য অর্জন করতে পারতামনা।
বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত হয়তো পৌঁছানোর দুঃসাহস ও হয়তো আমাদের হতো না।

(যদিও আমরা দেশ ব্যাপী মাধ্যমিক শিক্ষক ধর্মঘট ও অন্য স্কুলের ছাত্রীদের বোকামি সার্বিক পরিস্থিতির কারণে সবটা দাবি আদায় করতে পারিনি। )

আমি আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি বঙ্গবন্ধুর তুলনা বঙ্গবন্ধু ই। কিন্তু যদি ১৫ আগস্ট এর নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরে শুধু শেখ কামাল ভাই ও বেঁচে যেতেন, তবে এই বাংলাদেশের রূপ হতো অন্য রকম। সমৃদ্ধ হতো বাংলাদেশ এগিয়ে যেতো বহুদূর।


অথচ এই মহান দেশপ্রেমিক মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মেধাবী নিরহংকারী শেখ কামালের বিরুদ্ধে জঘন্যতম সব অপপ্রচার চালানো হয়েছে দেশী বিদেশী স্বাধীনতা বিরোধীদের কূট চক্রান্তে। আর সেই পালে হওয়া দিয়েছে আগুনে ঘি ঢেলেছে তৎকালীন জাসদ।

সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টিকে পাহারা দিতে গিয়ে দুর্ঘটনা বসত কামাল ভাই ও তার বন্ধুরা পুলিশের গুলিতে আহত হলেন। যার মধ্যে বর্তমান বি, এন, পি, নেতা টুকুও ছিলেন।

পরের দিন জাসদের পত্রিকা " গনকণ্ঠ " হেড লাইন করলো বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামাল আহত!! কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি। যার রেশ চলছে দুর্ভাগ্য জনকভাবে আজও।

আজকের প্রজন্মের কাছে আমার প্রশ্ন,

*) কোথাও কখনো ব্যাংকের ভোল্ট ভেঙে ডাকাতি হতে শুনেছেন ?
*) বাংলাদেশ ব্যাংক এর সেফটি ভোল্ট ভাঙা কি খুব সহজ কাজ ?
সেক্ষেত্রে তো মনে হয় শেখ কামাল রাইফেল নয় ট্যাংক নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
*) জাতির পিতা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর পুত্র কে কি টাকার জন্য ব্যাংক ডাকাতি করতে হয় ?

উনি চাইলেই তো তার এক কথায় লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারতেন বৈধ অবৈধ পথেই।
জাতির দুর্ভাগ্য আমরা তা বিশ্বাস করেছি অন্ধের মতো।

সে সময়ে ছাত্রলীগের "পদক্ষেপ" নামে একটি মাসিক মুখপত্র ছিলো। শেখ কামাল ভাই সেটির ও সার্বিক দেখা শুনা করতেন।

চলবে---------

শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৭)

 শ্রদ্ধেয় শেখ কামাল ভাই আমাদের নেতা ও রাজনৈতিক শিক্ষা গুরু : (পর্ব ৭) ১৯৭২ - ৭৩ সাল সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ। রেলপথ, নৌপথ, রাস...